ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার কালাদহে সন্ধ্যার পর ভয়ে ঘর থেকে বের হতো না মানুষ। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। কালাদহের নিজপাড়া গ্রামের যুবক দুলাল তখন ঢাকার তেজগাঁও কলেজে পড়েন। 
১৯৮১ সালে তিনি এইচএসসি পাস করেন। পরীক্ষার ফল জানাতে বাড়ি আসেন তিনি। একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখেন নদীর ওপরের যে কাঠের ব্রিজ ছিল তার সব কাঠ চোরে নিয়ে গেছে। গাঁয়ের মানুষ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন চোর-ডাকাতদের হাত থেকে গাঁয়ের লোকদের রক্ষা করবেন। গ্রাম ঘুরে তিনি যুবকদের সাহসী করে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যান। একপর্যায়ে ৩০ জন যুবক নিয়ে একটি দল গঠন করেন। রাত জেগে গ্রাম পাহারা দেওয়ার সেই শুরু। চুরি, ডাকাতি কিছুটা কমতে থাকে।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে একবার ফুলবাড়িয়া বাজারে বেড়াতে এসে পূর্বপরিচিত নূরুল ইসলামের দেখা হয়। তিনি আনসার ভিডিপির সদস্য। কালাদহের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা হয়। একপর্যায়ে দুলালকে তিনি তখনকার আনসার ভিডিপি কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলামের কাছে নিয়ে যান। কর্মকর্তা সব কিছু শোনার পর কালাদহের ৩০ জন যুবককে তিন দিনের একটি প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিন দিনের সেই প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেকে ১৫ টাকা করে সম্মানী ভাতা পান। ওই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে দুলালকে সভাপতি করে কালাদহ বাজারে আনসার ভিডিপি নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন কর্মকর্তা। সেই থেকে তিনি এই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এই ৩৫ বছরে দুলাল রাষ্ট্রপতি সেবা পদক পেয়েছেন একবার, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক পেয়েছেন দুই বার, বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীর কাছ থেকে পেয়েছেন একবার, আনসার ভিডিপি মহাপরিচালকের কাছ থেকে পেয়েছেন একাধিকবার। এ ছাড়া বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আরো অনেক পদক পেয়েছেন।
ডাকাত ধরে পুরস্কার
কালাদহ ও কালনাজানি গ্রামের ভয়ংকর ডাকাত লোকমান হোসেন। তার সঙ্গী কালু মিয়া, আলাউদ্দিন, কাইল্লা, হোসেন আলী, ইদ্রিস আলীসহ ১০ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দিতে পেরেছিল দুলালের দল। লোকমানকে ধরতে তাঁরা বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন। ডাকাতি করা মালামালও উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকা পুরস্কারও পেয়েছিলেন দুলাল। একাধিকবার তিনি ডাকাত ধরে পুরস্কার পেয়েছেন। একপর্যায়ে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক দুলালকে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সও প্রদান করেন।
 নৈশ বিদ্যালয় 
১৯৮৫ সালে কালাদহ নিজপাড়া, পুকুরিয়া ও বাহারচালা গ্রামে তিনটি মসজিদের মক্তবে নৈশ বিদ্যালয় করেন মোশারফ হোসেন দুলাল। সেখানে তিনিসহ আরো ১০ জন পাঠদান করতেন। প্রতিটি স্কুলে ৪০ থেকে ৫০ জন করে বয়স্ক শিক্ষার্থী ছিল। বিনা মূল্যে বই-খাতা-কলম দেওয়া হতো। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্লাস চলে। গ্রামের প্রায় দেড় হাজার মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন দুলাল।
গ্রাম উন্নয়ন
যুবকদের জন্য গৃহপালিত পশু-পাখি পালনবিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন দুলাল। ফলে গ্রামের অনেকে এখন গরুর খামার, মুরগির খামার পরিচালনা করছেন। ২০টি পরিবারকে দুলাল কুটিরশিল্প তৈরিতে সহযোগিতা দিয়েছেন। আনসার ভিডিবি ক্লাবের ২৬৫ জন নারী-পুরুষ সদস্যের জন্য পেশাভিত্তিক বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। ৪৬ জন দরিদ্র পরিবারকে ৪৬টি ভ্যানগাড়ি কিনে দিয়েছেন। ৪২৫ জনকে চার লাখ ২৫ হাজার টাকার শেয়ার ক্রয় করে দিয়েছেন আনসার ভিডিপি ব্যাংক থেকে। কালাদহ, রাঙামাটিয়া, নাওগাঁও—এ তিনটি ইউনিয়নের ৭১৫ জন সদস্য নিয়ে বরিল বিল কমিটি করার প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। সরকারিভাবে নির্মাণ করিয়েছেন বরিল বিল স্লুইস গেট। বরিল বিলের জমি থেকে এখন কৃষক হাজার হাজার মণ ধান উৎপাদন করে থাকে। অথচ একসময় বরিল বিলে শত শত একর জমির ধান বন্যা ও খরা মৌসুমে নষ্ট হয়েছে। 
মাদকদ্রব্য প্রতিরোধ 
ভিডিপি ক্লাবের সদস্যদের দিয়ে গ্রামে একটি জরিপ পরিচালনা করেন দুলাল। তাতে দেখা যায়, গ্রামের বেশির ভাগ যুবক গাঁজা বা মদে আসক্ত। তখন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি, স্কুল ও কলেজের ছাত্র এবং অভিভাবকদের নিয়ে মাদক বিষয়ে একাধিকবার উঠান বৈঠক করেন। শেষে ২০১৫ সালের জুন মাসে গণআলোচনা সভার আয়োজন করে তিনটি গ্রামকে মাদকমুক্ত ঘোষণা করেন। গ্রামের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে ২০১৬ সালে একটি শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট গঠন করেন। তাঁর চাচাতো ভাই আমেরিকাপ্রবাসী কামাল হোসেন তাঁকে এ ব্যাপারে আর্থিক সহায়তা দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের বই, খাতা, কলম ও নগদ অর্থ প্রদান করে থাকেন প্রতিবছর।
 বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা 
একসময় বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল গ্রামে। লোকে মলমূত্র ত্যাগ করত খোলা জায়গায়। অনেক বাড়িতেই নলকূপ ছিল না। খাবারের জন্য কুয়ার পানি ছিল ভরসা। অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে ভুগতেন। নিরোগ দেহ, সুন্দর মন, পরিশ্রমে মহামিলন—স্লোগান নিয়ে কালাদহ আনসার ভিডিপি ক্লাবের মাধ্যমে ৩২ জন সদস্যের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির জন্য একটি করে টিউবওয়েল স্থাপন করার ব্যবস্থা করেন মোশারফ হোসেন দুলাল। 
দুলাল বললেন
আমি যখন পৃথিবীতে থাকব না, তখন যেন পরবর্তী প্রজন্ম এ ক্লাবটি ধরে রেখে সঠিকভাবে পরিচালনা করে—এটাই আমার শেষ ইচ্ছা। প্রবল ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষ একটি সংগঠনের মাধ্যমে এলাকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে। বেকারত্ব নির্মূল করতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post