প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মের রাজত্বকাল শেষ হতে চলেছে। আগামী মাসে তিনি ডাউনিং স্ট্রিট ত্যাগ করবেন। ব্রিটিশ জনগণের যে অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে চায় এবং যারা থাকতে চায় না, তাদের কোনো অংশকেই তিনি খুশি করতে পারেননি। ব্রেক্সিট প্রশ্নে ইউরোপের কাছ থেকে বেস্ট ডিল আদায় করতে পারেননি। দলের ভেতর তাঁর জোরালো সমর্থন ছিল না। মন্ত্রিসভাতেও বিদ্রোহী মন্ত্রীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ এসেছে। শুধু তাঁর সমালোচকদের কাছ থেকে নয়, তাঁর এককালের সমর্থকদের কাছ থেকেও।
ব্রিটেনের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো ‘লৌহমানবী’ হবেন, এটি কেউ আশা করেনি। থ্যাচারের কনজারভেটিভ দল ছিল ঐক্যবদ্ধ এবং থ্যাচার ছিলেন বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিতর্কিত নেতা। তিন দফা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে টেরেসা মে ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনের টোরি মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী। ক্যামেরন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ না করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তাঁর দলের ভেতরেও ‘রিমেইনদের’ চেয়ে ‘লিভদের’ চাপ বেশি হওয়ায় তিনি গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। গণভোটের ফল ডিসাইসিভ হয়নি সামান্য মেজরিটিতে ‘লিভ’ সমর্থকরা জিতে যায়। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। লিভ সমর্থক টেরেসা মে নেতা নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন।
টেরেসা মে ব্রিটেনের দ্বিতীয় মহিলা প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বটে; কিন্তু প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের মতো দল ও দেশের মানুষের ওপর শক্ত প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। থ্যাচার ছিলেন ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের পক্ষপাতী। কিন্তু ব্রাসেলস যাতে লন্ডনের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন না করে, ‘ইউরো’ যাতে পাউন্ডের অস্তিত্ব বিলোপ না করে, ব্রিটিশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের আর্থিক লেনদেনেও তিনি কড়া ভূমিকা নিয়েছিলেন। পদত্যাগের সময়ও তিনি প্যারিসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
নির্বাচনে হেরে মার্গারেট থ্যাচার ক্ষমতা ছাড়েননি। দলের ভেতরে তাঁর নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন। তিন তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু এই লৌহমানবীও রানির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিতে যাওয়ার সময় প্রকাশ্যে কেঁদেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে-ও নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা ছাড়েননি। তবে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তাঁর আসন ছিল নড়বড়ে। তিনিও ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে কেঁদেছেন।
নিজ দলের সমর্থন নিয়ে সন্দেহ থাকায় তাঁকে বন্ধু নয়—এমন একটি সংসদীয় আইরিশ দলকে প্রচুর অর্থ ও সুবিধা দিয়ে তাদের সমর্থন অর্জন করে ক্ষমতায় থাকতে হয়েছে। প্রতিপক্ষ লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে হয়েছে। ব্রেক্সিট প্রশ্নে টেরেসার টোরি সরকার করবিনের লেবার পার্টির সঙ্গে একটা আপস করবেন—এমন গুজবও বাজারে ছড়িয়েছিল। এ সমস্যা থেকে ব্রিটেন যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সে জন্য দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠানেরও কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। দ্বিতীয় গণভোট অনুষ্ঠানের প্রশ্নেও ব্রিটিশ জনমত দ্বিধাবিভক্ত।
আগামী জুন মাসে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি শূন্য হলে কে সেই বাড়িতে ঢুকবেন, তা এখনো বলা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক। তাঁদের মধ্যে বরিস জনসনের হাঁকডাকই বেশি। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়লে বরিস জনসনেরই সেই পদ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল বেশি। কিন্তু তাঁরই সমর্থক মন্ত্রী মাইকেল গোভ নিজেই প্রার্থী হওয়ায় এবং নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে টেরেসা মের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়ায় বরিস জনসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ান।
এবার অনেকের সঙ্গে তিনি আবার টোরি দলের নেতৃত্ব লাভের দ্বন্দ্বে নেমেছেন। তাঁকে আবারও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন মাইকেল গোভ। আরো তিন প্রতিদ্বন্দ্বী জেরেমি হান্ট, হ্যাগেক ও স্টুয়াট। গোভ ঘোষণা করেছেন, ব্রেক্সিট সমস্যা থেকে ব্রিটেনকে উদ্ধার করার ব্যাপারে তিনিই সবচেয়ে যোগ্য প্রার্থী। ব্রিটিশ মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, টোরি সরকারের নেতৃত্ব বদল হলেও ব্রেক্সিট সমস্যার সহজ সমাধান হবে না। সাম্প্রতিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, টোরি পার্টির জনসমর্থন সর্বনিম্নে নেমেছে।
ব্রিটেনের মানুষ এখন একটি দ্বিধাবিভক্ত জাতি। এই জাতিকে আবার ঐক্যবদ্ধ করা টোরি পার্টির মতো দ্বিধাবিভক্ত ও জনসমর্থনহীন দলের পক্ষে সম্ভব নয়। বরিস জনসনের আগে যে ক্যারিসমা ছিল, তা এখন নেই। পরকীয়া প্রেমের দুর্নাম তাঁর পারিবারিক জীবনে বিপর্যয় এনেছে। ব্রিটেনের রাজনৈতিক জীবনে ব্রেক্সিট যে মহাপ্রলয় এনেছে, জনসন-নেতৃত্ব এবং জনগণের আস্থাহীন টোরি পার্টি তা কতটা সামাল দিতে পারবে সে সম্পর্কে অনেকেরই সন্দেহ আছে। কেউ কেউ বলছে, এ সমস্যা সমাধানে ব্রিটিশ জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত শক্তিশালী নতুন সরকার দরকার।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন এখন যথেষ্ট জনপ্রিয় নেতা। কিন্তু ব্রেক্সিট প্রশ্নে লেবার পার্টিতেও মতানৈক্য আছে। দলের ভেতরে ব্লেয়ারপন্থীরা এবং দলের বাইরে বিগ মিডিয়া করবিনের বিরুদ্ধে নিত্য বানোয়াট ও নানা ধরনের সত্য-মিথ্যা প্রচারণায় ব্যস্ত। বিভক্ত ব্রিটেনের রাজনীতিতে করবিন নানা চাপের মুখে বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি না এবং ব্রেক্সিট সমস্যার সহজ সমাধানে পৌঁছতে পারবেন কি না, এটি এখন মিলিয়ন পাউন্ড প্রশ্ন।
ব্রেক্সিট শুধু ব্রিটেনের একার সমস্যা নয়, এটি গোটা ইউরোপের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে ডলার, স্টার্লিং এবং ইউরোর ভবিষ্যৎও জড়িত। অর্থাৎ এ সমস্যা সমাধানের ওপর ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সমস্যাটি এখন প্রকট। কিন্তু এর সূত্রপাত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন এবং পরবর্তীকালে (ব্রিটিশ) কমনওয়েলথের গুরুত্ব হারানোর পর। গত শতকের চল্লিশের দশকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে ফাটল ধরার পরও বিশ্বে স্টার্লিং সাম্রাজ্যের আধিপত্য অটুট ছিল।
ব্রিটিশরাজ সাম্রাজ্য হারানোর পর এশিয়া-আফ্রিকার সাবেক উপনিবেশগুলোকে কমনওয়েলথ নামে ব্রিটিশ মনার্কির অধীনে একটি সংস্থায় ঐক্যবদ্ধ রেখে তার ‘স্টার্লিং সাম্রাজ্য’ বজায় রেখেছিল। স্টার্লিং ছিল সর্বাধিক শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মুদ্রা। মার্কিন ডলার তখনো ততটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। ইউরো মুদ্রা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জন্ম নেয়নি।
ব্রিটেন বিশ্বে সামাজ্যবাদী আধিপত্য হারানোর পর তার অর্থনৈতিক আধিপত্যও দ্রুত হারাতে শুরু করে। আমেরিকা এ সময়টাকে আখ্যা দেয় পাওয়ার ভ্যাকুম বা শক্তিশূন্যতার যুগ। অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনে বিশ্বে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দিয়েছে, তা অবিলম্বে আমেরিকাকে পূর্ণ করতে হবে। নইলে পশ্চিমা সভ্যতা ও আধিপত্যের অবসান ঘটবে। ব্রিটেনের পরিবর্তে আমেরিকাকে তাই বিশ্ব ধনতন্ত্র ও বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে।
শক্তিশূন্যতার তত্ত্ব অনুসরণ করে আমেরিকা সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুরু করে। পাকিস্তানে ব্রিটিশভক্ত নাজিমুদ্দীন সরকারকে উত্খাত করে মার্কিন-স্টুপ বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে ক্ষমতায় আনা হয় এবং পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে বিশাল তেল সম্পদের ওপর ব্রিটিশ একচেটিয়া মালিকানার বদলে মার্কিন মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ মালিকানায় পরিচালিত অ্যাংলো ইরানিয়ান অয়েল কম্পানিকে ধীরে ধীরে মার্কিন মালিকানায় নিয়ে আসা হয়।
বিশ্বে স্টার্লিং সাম্রাজ্য সংকুচিত হতে থাকে। কালক্রমে ডলার হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব বাণিজ্যের প্রধান নিয়ামক শক্তি। বিশ্বে যে দেশটির ডলার রিজার্ভ বেশি, সে দেশটিই উন্নত দেশ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে। ব্রিটেন বেশ কিছুকাল তার সাবেক উপনিবেশগুলোতে মার্কিন আধিপত্য ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার অর্থনীতির টিকিটি পর্যন্ত মার্কিন ঋণের কাছে তখন বাধা। তার ওপর আমেরিকা তখন বিশ্বের একমাত্র আণবিক শক্তি। আমেরিকার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ব্রিটেন নামে তার বিশ্বশক্তির খেতাবটি গায়ে ঝুলিয়ে রাখতে চেয়েছিল। এ জন্যই ইরাক যুদ্ধের শুরু থেকেই জর্জ ডাব্লিউ বুশ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে অধীনস্থ মিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধ শুরু করার দিন তাঁকে খবর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপ ছিল দীর্ঘকাল আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল। ইউরোপে কমিউনিজমের দ্রুত বিস্তার ঘটবে—এ আশঙ্কায় আমেরিকা মার্শাল প্ল্যানের মাধ্যমে দ্রুত ইউরোপের অর্থনীতি চাঙ্গা করে তোলে। ন্যাটো চুক্তি দ্বারা সারা ইউরোপকে মার্কিন আধিপত্যের অধীনে নিয়ে আসে। এই মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহী হন ফ্রান্সের দ্য গল। ইউরোপে সোভিয়েত আধিপত্য ঠেকানোর অসিলায় মার্কিন একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা ইউরোপের বহু দেশে ক্ষোভ সৃষ্টি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন এবং ইউরো নামের মুদ্রাব্যবস্থার কনসেপশনের জন্ম সম্ভবত তখনই, ইউরোপে ডলার সাম্রাজ্যের বিস্তার রোধে ইউরো কার্যকর ভূমিকা নেবে—এটি অনেকেই আশা করেছিল।
ব্রিটিন তত দিনে প্রধানত এশিয়া ও আফ্রিকার সাবেক উপনিবেশগুলো নিয়ে গঠিত কমনওয়েলথের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। কমনওয়েলথের এই বিশাল মার্কেটে স্টার্লিং তখন আধিপত্য হারাচ্ছে। ডলার বাজার দখল করে নিচ্ছে। ব্রিটেন ইউরোপিয়ান মার্কেটে ঢুকে কমনওয়েলথ মার্কেট হারানোর ক্ষতি পূরণ করতে চেয়েছে। অন্যদিকে এশিয়া ও আফ্রিকার কালো ইমিগ্র্যান্টদের তারা ভয় পেতে শুরু করেছিল, দলে দলে ব্রিটেনে ঢুকে তারা না আবার শ্বেতাঙ্গ দেশটির সামাজিক কাঠামো বদলে ফেলে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। কিন্তু তার পাউন্ডভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বদলাতে রাজি হয়নি।
ইসিতে যোগ দেওয়ার পর ব্রিটেনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধারণা হয় এই যোগদানে লাভের পাল্লা ভারী হয়নি, ক্ষতির পাল্লা হয়েছে। ইউরোপের মার্কেটে ব্রিটিশ পণ্য বিদেশি, বিশেষ করে চীনের পণ্যের সঙ্গে আরো বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। ব্রিটিশ আদালত এখন ইউরোপিয়ান আদালতের অধীন। মানবাধিকার থেকে শ্রমিক আইন—বহু ক্ষেত্রে লন্ডনের সঙ্গে ব্রাসেলসের আইন সাংঘর্ষিক। ইউরোপ, বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে বহিরাগতের আগমন এবং ব্রিটেনের সামাজিক জীবনে ভাঙন সৃষ্টি ও ওয়েলফেয়ার ব্যবস্থায় এই ইমিগ্র্যান্টদের একাংশের অবাধ লুটপাটের নীতি দেশটির অনেককেই রীতিমতো ভীতিগ্রস্ত করে তুলেছে।
আবার ব্রিটিশ জনগণের একাংশ ইসি ত্যাগের বিরোধী। তারা ইউরোপের বাজারে চাকরিবাকরি ও ব্যবসার সুবিধা হারাতে নারাজ। ইউরোপ ছাড়লে ব্রিটেনের অর্থনীতিতে এবং শ্রমের বাজারে আশু যে বিপর্যয় দেখা দেবে, তারা আবার তা নিয়ে ভীত। সম্ভবত ব্রেক্সিট প্রশ্নে ব্রিটিশ জাতি যতটা বিভক্ত হয়েছে, টোরি ও লেবার দল যেভাবে জনগণের আস্থা হারিয়েছে, তা স্মরণকালে আর কখনো হয়নি। ব্রেক্সিটের ফলে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ব্রিটেনের সীমান্ত সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্কটল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব বেড়েছে। ব্রিটেন ইসি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলেও স্কটল্যান্ড হয়তো চাইবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার প্রশ্নে অনুষ্ঠিত গণভোটে ‘লিভ’-এর সমর্থনে সামান্য বেশি ভোট পড়লেও যতই দিন যাচ্ছে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং দীর্ঘকাল ধরে যে বিতর্ক ও বিরোধ চলছে, তার অবসানের জন্য দ্বিতীয় গণভোটেরও দাবি উঠেছে। টেরেসা মে আশা করছিলেন, ইসি ছেড়ে দিলেও তিনি ইসির সঙ্গে এমন একটি ডিল করবেন—এমন সব সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে পারবেন, যাতে ব্রিটিশ জনগণ খুশি হবে। তিনি তাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ‘লিভ’ এবং ‘রিমেইন’ কোনো পক্ষকেই খুশি করতে পারেননি। তাঁর মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যও তাঁর পদত্যাগের দাবি জানাচ্ছিলেন।
টেরেসা মের পদত্যাগ বা অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত টোরি সরকারের নতুন নেতা নির্বাচন দ্বারা ব্রেক্সিট সংকট থেকে ব্রিটেন শিগগিরই মুক্ত হবে এবং জাতীয় ঐক্য ফিরে আসবে, তা মনে হয় না। ব্রিটেন এখন ইতিহাসের দীর্ঘকালের পোষিত প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছার মুখে পড়ে গেছে মনে হয়। ব্রিটেন ২০০ বছর ধরে একটি নীতি অনুসরণ করেছে। তা হলো ডিভাইড অ্যান্ড রুল, বিভাগ করো ও শাসন করো।
ব্রিটিশ লর্ড ব্যালকুর সাহেব মধ্যপ্রাচ্যের আরব ভূমিকে বিভক্ত করে একটি ‘রোগ-স্টেট’ ইসরায়েলের জন্ম দিয়ে যে হিংসা ও হানাহানি সূচনা করে গেছেন, তা কোনো দিন শেষ হবে, তা মনে হয় না। আয়ারল্যান্ডকে বিভক্ত করে ২০০ বছরের বেশি সেখানে রক্ত ঝরানো হয়েছে। রেডক্লিক সাহেব ভারতকে ভাগ করেছেন এবং কাশ্মীরসহ যেসব রক্তক্ষয়ী সমস্যার জন্ম দিয়ে গেছেন, তার সমাধান কবে হবে, কবে এই শিশুঘাতী ও নারীঘাতী বর্বরতা বন্ধ হবে, তা কেউ জানে না।
ব্রিটেনের এই বিভাজননীতির অভিশাপই আজ তার শিরে নেমে এসেছে। শুধু ইউরোপ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয়, গ্রেট ব্রিটেনেরও আজ গ্রেটনেস হারিয়ে গিয়ে ‘লিটল ইংল্যান্ডে’ পরিণত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
লন্ডন, রবিবার, ২৬ মে ২০১৯
Post a Comment