ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আস শামস জগলুল হোসেন পরোয়ানা জারির নির্দেশ দেন।
ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির করা যৌন হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনা ভিডিওতে ধারণ এবং সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে এই মামলা করা হয়। অভিযোগ ওঠার পর গত ১০ এপ্রিল সোনাগাজী থেকে তাঁকে প্রত্যাহার করে রংপুর রেঞ্জে বদলি করা হয়। গত ৮ মে তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার পর গত সপ্তাহে তিনি রংপুর রেঞ্জ অফিসে যোগ দেন। দুই দিন আগেও তাঁকে রংপুরে দেখা গেছে, কিন্তু এখন তিনি কোথায় আছেন সেই তথ্য নেই পুলিশের কাছে। তবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হাতে পেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি অফিসের স্টাফ অফিসার, সহকারী পুলিশ সুপার শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েক দিন আগে মোয়াজ্জেম হোসেন রংপুর রেঞ্জে যোগদান করেন। তবে শুনেছি তিনি ঢাকা সদর দপ্তরে অবস্থান করছেন।’ গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো কাগজ পাইনি।’
রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, ‘গত সপ্তাহে তিনি রংপুর রেঞ্জে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর রংপুরেই থাকার কথা। তবে শুনেছি তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।’ গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিষয়ে ডিআইজি বলেন, ‘এই বিষয়টিও আপনাদের মাধ্যমে শুনেছি। পরোয়ানা হাতে পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ 
গত ১৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ট্রাইব্যুনাল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮-এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা  মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেন। গত রবিবার পিবিআই ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।  মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই সদর দপ্তরের সিনিয়র এএসপি রিমা সুলতানা প্রতিবেদনে বলেন, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে যৌন নিপীড়নের ঘটনার পর তাঁকে থানায় জেরা করার দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে ধারণ করেন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন।
রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পর তার পরিবারকে সহযোগিতা না করারও অভিযোগ রয়েছে ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে। মামলার আরজিতে বলা হয়েছে, গত ২৭ মার্চ সকাল ১০টার দিকে মাদরাসার অধ্যক্ষ তাঁর অফিসের পিয়ন নূরুল আমিনের মাধ্যমে রাফিকে ডেকে নেন। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন অধ্যক্ষ। পরে পরিবারের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি। আরজিতে আরো বলা হয়, যৌন হয়রানির অভিযোগ করতে যাওয়ার পর সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসির কক্ষে আরেক দফা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল নুসরাতকে। ওসি নিয়ম না মেনে জেরা করতে করতেই নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। মৌখিক অভিযোগ নেওয়ার সময় ডিডিওতে দুজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী ছিল না। নানা রকম কুরুচিপূর্ণ প্রশ্ন করা হয় মেয়েটিকে। এরপর ওই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন ওসি মোয়াজ্জেম। শিক্ষার্থী রাফিকে মানসিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য ভিডিও করা এবং তা ছেড়ে দেওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন ও বিচার্য বিষয়।
উল্লেখ্য, অধ্যক্ষ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে মাদরাসায় যায় রাফি। মাদরাসার এক সহপাঠী ছাত্রী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে—এমন সংবাদ দিলে রাফি ওই ভবনের তিন তলায় যায়। সেখানে গেলে তাকে মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়া হয়। রাজি না হওয়ায় দুর্বৃত্তরা তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রাফি মারা যায়। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করা হয়েছে।
এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়েও ওসি মোয়াজ্জেম রাফির পরিবারকে সহযোগিতা করেননি। এমনকি হত্যাকাণ্ড ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। রাফিকে জেরা করার সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন ওসি মোয়াজ্জেম। গত ১৪ এপ্রিল কালের কণ্ঠে ‘পাঁচ অপরাধে বিচারযোগ্য ওসি মোয়াজ্জেম’ শিরোনামে খবর প্রকাশিত হয়। এরপর এই মামলা দায়ের করা হয়।

Post a Comment

Previous Post Next Post