পাকিস্তানে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা খুবই কম। পুরো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে খুব জোর ১ শতাংশ। ব্যবসায়ে নারীদের এগিয়ে না আসার মূল কারণ হাতে নগদ অর্থের অভাব। ঋণ দেওয়া হয় জেন্ডারের ভিত্তিতে। স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, স্বল্প ও মাঝারি পর্যায়ের ঋণ দেওয়া হয় মাত্র ৩ শতাংশ নারীকে। যেখানে পুরুষদের জন্য বরাদ্দ ৯৭ শতাংশ। 

ক্ষুদ্রঋণ নারীদের দেওয়া হয় মাত্র ১৩ শতাংশ। পুরুষরা পায় ৮৭ শতাংশ। এমনকি ব্যবসায়ে আগ্রহী নারীদের ব্যাংক হিসাব খুলতেও বাবা বা স্বামীর পরিচয় সংযুক্ত করতে হয়। ব্যাংকের নিয়ম-নীতির কারণে এই বৈষম্য করা হচ্ছে বিষয়টি কিন্তু তেমন নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ব্যাংকগুলো মনে করে, নারী ক্লায়েন্টদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। তারা কোনো না কোনোভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল এবং তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ কঠিন। কাঠামোগত এই প্রতিবন্ধকতাগুলোর পরও এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কী ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যেতে পারে সে সম্পর্কেও শহর বা গ্রামীণ নারীরা অবহিত নয়। পাকিস্তানে নারী চাকরিজীবীর সংখ্যাও খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক নয়, মাত্র ৪.৩ শতাংশ। কাজের পরিবেশই নারীদের নিরুৎসাহ করে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে নারীর কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সুবন্দোবস্ত, ডে-কেয়ার বা কর্মক্ষেত্রে হয়রানিবিরোধী আইনও কার্যকর নয়। গ্রামের মেয়েদের ভোগান্তি আরো বেশি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অশিক্ষিত, দরিদ্র এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন এসব নারী নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হয়। 
ফলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার পথে এগোতে পারছে না নারীরা। রাচেল এস শিনার, ওলিভার গিয়াকোমিন ও ফ্রাংক জানসেন তাঁদের ‘ব্যাবসায়িক ধারণা ও উদ্দেশ্য : জেন্ডার ও সংস্কৃতির ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন, নারী ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে তিনটি প্রতিবন্ধকতা রয়েছে—সহায়তার অভাব, ব্যর্থতার ভয় ও অদক্ষতা। পাকিস্তানের মতোই দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশের নারী পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মনোভাবের কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। মূলত দুটি প্রবণতা—পুরুষের ওপর নির্ভশীলতা এবং নারী-পুরুষের মধ্যে সম্পদ ও সুযোগ বণ্টনে বৈষম্য—অর্থনৈতিকভাবে নারীকে স্বাবলম্বী হতে সব সময়ই পেছনের দিকে টেনে রাখে। এর পাশাপাশি  দারিদ্র্য, অশিক্ষা এবং পরিবারের বাধার মতো বিষয়গুলো পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। নারীর অস্তিত্ব ও সম্পদ পুরোপুরি সঙ্গী পুরুষের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সরকারও নারী ক্ষমতায়নকে সমর্থন করে এমন সাংস্কৃতিক বা সামাজিক পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারেনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল পরিচালিত ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, নারী ক্ষমতায়ন এবং শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে।
পাকিস্তান ‘অ্যাট দ্য রেট ১০০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাংকের মতে, ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে পাকিস্তান তার মোট শ্রমশক্তির মাত্র ৪০ শতাংশ ব্যবহার করছে। যে কারণে তাদের অর্থনীতি এখনো দুর্বল। পরিস্থিতি পরিবর্তনে বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানকে নারীদের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছে।
গত শতাব্দীর আটের দশকের গোড়ার দিকে ব্যবসাক্ষেত্রে নারীরা কেন ব্যর্থ হচ্ছে তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। বয়স, প্রবণতা ও শিক্ষাকে সামনে রেখে কাজ শুরু করে তারা। তারা বোঝার চেষ্টা করে পুরুষরা প্রাকৃতিকভাবেই কী করে ব্যবসায় সফল হয়। তবে প্রত্যেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি বিষয় আছে এবং পারিপার্শ্বিকতাকেও এড়ানো সম্ভব নয় বলে এই গবেষণা বাতিল করে দেওয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণাগুলো পরিচালনা করা হয় ‘ব্যাবসায়িক পরিবেশ’ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে। এতে বলা হয়, ব্যাবসায়িক তৎপরতার সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের ওপর। এতে ধারণা দেওয়া হয়, নারী ব্যবসায়ীদের আইনগত অধিকার, শিক্ষার সুযোগ, জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম চর্চার সুযোগ দিতে হবে। বিশ্ব এখন আর ‘নারীরা পারছে না কেন’ বা ‘এই ব্যবস্থায় গলদ কোথায়’—এর মধ্যে আটকে নেই। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে পাকিস্তানকেও তাদের ব্যবস্থায় উন্নতি আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারী ক্ষমতায়ন ব্যবস্থার অনুসরণ করা যেতে পারে। যদিও বিষয়টিকে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে নিতে হবে। বাংলাদেশে ব্যাংকগুলো নারী উদ্যোক্তাদের ১৫ শতাংশ ঋণ দিতে বাধ্য। একই সঙ্গে লক্ষ্য অর্জনে নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতির ওপরও নজর রাখতে হয় তাদের। পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধির সঙ্গে জেন্ডারভিত্তিক এই সূচক জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি। ব্যবসায়ে নারীদের উৎসাহিত করা এবং নারীদের জীবনে এর প্রভাব নিশ্চিত করতে সরকারকে অবশ্যই নীতিনির্ধারণ ও উদ্যোগ নিতে হবে। যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমেই নারীদের সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। আর পাকিস্তান তার মানবশক্তির ৬০ শতাংশ লুকায়িত সম্ভাবনা ব্যবহারে সক্ষম হবে।
সূত্র : দ্য নেশন
লেখক : কলামিস্ট
ভাষান্তর : তামান্না মিনহাজ

Post a Comment

Previous Post Next Post