শ্যামপুরের এ লেগুনে চাষ হচ্ছে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, আফ্রিকান মাগুর, সিলভার কার্প ও নাইলোটিকা নয়, ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে রুই, কাতলা, মৃগেল আর নলা। বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণাগার এবং মৎস্য অধিদফতরের পরীক্ষায় এসব লেগুনের মাছে মাত্রাতিরিক্ত কলিফর্ম, ইকোলাই এবং অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা, ক্যাডমিয়াম, পারদ প্রভৃতি পদার্থ পাওয়া গেছে। কলিফর্ম জীবাণু ডায়রিয়া, জন্ডিস, যকৃৎসহ পাকস্থলী ও পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। ইকোলাই কিডনি ক্রমশ অচল করে দেয়। স্নায়ুতন্ত্রের উপরেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে।ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন বাজারের ক্রেতাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, তারা এসব বিষাক্ত মাছ কিনছেন এবং সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
এসব লেগুনে মাছ চাষের শুরু গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। স্থানীয় কিছু লোক মাছ চাষ করে ব্যাপক লাভবান হওয়ার পর ওয়াসার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমবায় সমিতি ওয়াসার অনুমোদন নিয়ে লেগুনগুলো বাণিজ্যিকভিত্তিতে মাছ চাষের জন্য লিজ দিতে শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ওয়াসা নিজ উদ্যোগে একাধিক বৈজ্ঞানিক সংস্থার মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়ে মাছ বিষাক্ত হওয়ার প্রমাণ পায়। তারপর লিজ বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু লেগুনে মাছ চাষ চলছেই। বিশেষত, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় এ বিষাক্ত মাছ চাষ করছে।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২ মাস পরপর বিষ ঢেলে মাছ নিধনের কথা থাকলেও ওয়াসা বিষ দেয় বছরে মাত্র একবার। স্থানীয়রা একে বলছেন, ‘আই ওয়াশ’। মাছ নিধনের আগে রাতের আঁধারে জাল ফেলে সব মাছ ধরার পর লেগুনে বিষ ঢালা হয়। সারা বছরই রাতের আঁধারে লেগুনা থেকে মাছ ধরে ট্রাক-পিকআপে করে নেয়া হয় সোয়ারীঘাট, যাত্রাবাড়ীসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। কিছু মাছ চলে যায় নারায়ণগঞ্জে। তুলনামূলক সস্তা হওয়ায় পাইকারি মাছ ব্যবসায়ীদের কাছে এসব মাছের ব্যাপক চাহিদা।
স্থানীয়রা বলেন, মাছ চাষ ও ধরার নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকা ম্যাচ ফ্যাক্টরির সাবেক সিবিএ নেতা ও শ্রমিক লীগ নেতা মো. শাহজাহান ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি মো. হোসেন। একই কথা বলেন শ্যামপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হারুন অর রশীদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ওয়াসার লেগুনে মাছ চাষ ও মাছ ধরার নেতৃত্বে মো. শাহজাহান এবং হোসেন। তারাই ওয়াসাকে ম্যানেজ করে লেগুন থেকে মাছ ধরে ব্যবসা করছেন।
স্থানীয় কৃষক লীগের এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, লেগুনে এখনও মাছ চাষ হয়। লেগুনের মাছ চাষ ও মাছ ধরে বিক্রির নেতৃত্বে রয়েছেন শাহজাহান। বেশ কয়েকটি লেগুনায় হোসেন মাছ চাষ করে। এ দু’জনের নেতৃত্বেই চলে মাছ চাষ ও ধরা। তাদের অনেক সহযোগীও রয়েছে। তাদের সঙ্গে অনেক রাঘববোয়ালও জড়িত।
পাগলার পয়ঃশোধনাগারের ওয়াসা গেটের একাধিক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ওয়াসার কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও আনসার সদস্যদের সহযোগিতায় ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা লেগুনে মাছ চাষ করে। ১৬টি লেগুনের মধ্যে ১ ও ২ নম্বর লেগুনেই বেশি মাছ চাষ করা হয়। অন্য লেগুনগুলোতে প্রাকৃতিকভাবেই মাছ উৎপাদন হয়। একটি লেগুনে একবার জাল টানলে এক পিকআপ মাছ ধরা পড়ে। লেগুনে মাছ চাষ ও মাছ ধরে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন ওয়াসার কিছু অসাধু কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে শ্রমিক লীগ নেতা মো. শাহজাহানের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে একজন নারী তা রিসিভ করেন। শাহজাহানের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, শাহজাহান অসুস্থ। এখন কথা বলতে পারবেন না। অন্যদিকে মো. হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ৮-১০ বছর আগে আমি লেগুনে মাছ চাষ করতাম। এখন করি না। এর সঙ্গে শাহজাহান জড়িত। তার সঙ্গে অনেকেই রয়েছেন। মোবাইল ফোনে এত কথা বলা তো সম্ভব নয়।
Post a Comment