‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম
হিন্দু মুসলমান।’
কবি নজরুল একাধারে অসাম্প্রদায়িক আর সমন্বয়বাদী কবি ছিলেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ওপরে উদ্ধৃত ফুলটির মতোই নিটোল ছিল, যার নিগড়ে ছিল দুটি সত্তা—ইসলামিক আর বৈদিক। আমার এ নিবন্ধে নজরুলের বাংলা ভাষার মাধ্যমে বাঙালির মনে ধর্মের মৌলিক তাড়নার সঙ্গে পরিচিতি বাড়ানোর প্রচেষ্টা সম্পর্কে আলোচনা করব। আমি এটা বলছি না যে নজরুল ধর্ম-প্রচারকের ভূমিকায় নেমেছিলেন; কিন্তু ইসলামী গান, আমপারার তরজমা এবং অন্যদিকে হিন্দু ধর্মের আজ্ঞানুযায়ী ভক্তিমূলক গান রচনা করার পেছনে তাঁর ধর্মের প্রতি মানুষের মন যেন সঠিক কারণে ধাবিত হয়, সেদিকে লক্ষ ছিল। মানুষ তো কোনো কাজ উদ্দেশ্যবিহীন করে না। তবে এ আলোচনায় আমি নজরুলের ভক্তিমূলক গান রচনার বিষয়টি আনব না, কেননা ওগুলো রচনার সঙ্গে বৈদিক ধর্মের ভাষার মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। অর্থাত্ হিন্দুদের ধর্মানুযায়ী ভক্তিমূলক গান রচনা করতে নজরুলকে অনুবাদকের ভূমিকায় নামতে হয়নি। তবে নজরুলের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বুঝতে এ তথ্যটাই সহায়ক—যেটি অধ্যাপক র্যাচেল ফেল ম্যাকডারমট তাঁর ‘সিংগিং টু দ্য গডেস : পোয়েমস টু কালি অ্যান্ড উমা ফ্রম বেংগল’ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০১) গ্রন্থে বলেছেন যে এই ঘরানার কবিদের মধ্যে নজরুল ইসলামই একমাত্র মুসলমান কবি ছিলেন। কিন্তু আমি নজরুলের ইসলামী গান ও আমপারার তরজমার প্রসঙ্গ এ জন্য আনছি, কারণ নজরুল সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলা ভাষায় ধর্ম পাঠ ও ব্যবহার না করলে বাঙালি মুসলমানরা অন্ধকারে থেকে যাবে। ঠিক যেমন ষষ্ঠদশ শতকের শুরুর দিকে ইংরেজ মনীষী উইলিয়াম টিনডেল বাইবেল হিব্রু এবং গ্রিক টেক্সট থেকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে প্রবৃত্ত হোন। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম পবিত্র গ্রন্থ অনুযায়ী পালন করতে গেলে যার যার মাতৃভাষায় পালন করতে হবে।
নজরুল তাঁর ‘কাব্য আমপারা’ অনুবাদের মুখবন্ধে বলছেন সে রকমেরই একটি কথা— ‘ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র-পুঁজি ধনরত্ন মণি-মানিক্য সব কিছু কোরআন মজীদের মণি-মঞ্জুষায় ভরা, তা-ও আবার আরবি ভাষার চাবি দেওয়া। আমরা বাঙালি মুসলমানেরা তা নিয়ে অন্ধ-ভক্তি ভরে কেবল নাড়াচাড়া করি। ...আজ যদি আমার চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিগণ এই কোরআন মজীদ, হাদিস, ফেকা প্রভৃতির বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন তা হলে বাঙালি মুসলমানের তথা বিশ্ব-মুসলিম সমাজের অশেষ কল্যাণ সাধন করবেন। অজ্ঞান-অন্ধকারের বিবরে পতিত বাঙালি মুসলমানদের তাঁরা বিশ্বের আলোক-অভিযানের সহযাত্রী করার সহায়তা করবেন।’ (মনোয়ার হোসেন, ‘নজরুলের কাব্য আমপারা’, নজরুল ইনস্টিটিউট, ২০০১, পৃ. ১১।)
বিশিষ্ট নজরুলসংগীত গায়িকা মোস্তারী পারভীন টিনা তাঁর ‘নজরুলের ইসলামী গান ও ভক্তিগীতি’ গ্রন্থে (২০১৩) জানাচ্ছেন, নজরুল হজরত মুহাম্মদ (সা. )-এর ওপর তাঁর সর্বাধিক ইসলামিক গান লিখেছিলেন। তাঁর আবির্ভাব, তিরোভাব এবং মহিমা কীর্তন করে তিনি গান রচনা করেছিলেন। এ ছাড়া আল্লাহর প্রশস্তিমূলক গান ‘হামদ’ ও ঈদ, রমজান, আজান, মসজিদ ও নামাজ এবং মহররমের ওপর তিনি গান লিখেছিলেন। গান লিখেছিলেন বিবি ফাতেমার ওপর, আরব, মক্কা, মদিনার ওপর। গজলের প্রসার নজরুলের হাতেই ঘটেছিল।
দুই.
ইংরেজ কবি ডাব্লিউ এইচ অডেন কবিতায় কবির জীবনকে খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। ১৯৩৬ সালে রচিত ‘হু ইজ হু’ শীর্ষক একটি কবিতায় এ প্রচেষ্টাকে ঠাট্টা করে লিখেছেন যে এক শিলিং দিয়ে কেনা যেকোনো জীবনচরিত কবির জীবন সম্পর্কে তোমাকে সব তথ্য দেবে : কবে তাকে পিতা পিটিয়েছিল, কবে সে স্কুল পালিয়েছিল ইত্যাদি। কবিতাটি একটি চতুর্দশপদী। ষষ্ঠীপদে গিয়ে বলছেন, হয়তো কবি সম্পর্কে তোমাকে এমন তথ্যও দেওয়া হবে যে কোনো গৃহরমণীর জন্য কবির প্রাণ উদ্বেলিত ছিল, যে গৃহরমণী আবার ছিলেন ভয়ংকর গৃহকাজে ব্যস্ত, আর কবির প্রতি ছিলেন সাংঘাতিক উদাসীন, যিনি কবির প্রেম-ভরভর লম্বা লম্বা চিঠির কোনোটির হয়তো উত্তর দিতেন, বেশির ভাগেরই দিতেন না; কিন্তু কোনো চিঠিই সংগ্রহে রাখতেন না।
অডেন ছিলেন টি এস এলিয়টরা ইংরেজি কবিতার যে আধুনিক ঘরানা তৈরি করেছিলেন, সে ঘরানার শেষ পর্যায়ের কবি। এরপর উত্তরাধুনিক যুগের শুরু হয় এবং সাহিত্যালোচনা কবিতার কেন্দ্রগুলোকে ছেড়ে প্রান্তবর্তী প্রদেশগুলোতে মনোনিবেশ করে, যার প্রধানতম আলো পড়ে কবি বা লেখকের জীবনের ওপর। জীবন ও যুগভিত্তিক সাহিত্য পাঠের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক এক অর্থে যেমন এডওয়ার্ড সাঈদ, আরেক অর্থে নব্য ইতিহাসবিদের জনক অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট। ২০১৭ সালে গ্রিনব্ল্যাট একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যেটির শিরোনাম ‘দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব অ্যাডাম অ্যান্ড ঈভ’। বইটি মূলত কী করে জেনেসিস এবং বাইবেল কথিত আদম এবং হাওয়া ধর্মীয়-পুরাণ থেকে বাস্তবে রূপ পেতে পেতে ক্রমে অগ্রসরমাণ বৈজ্ঞানিক খোঁজের আলোকে অবাস্তব এবং অপসৃয়মাণ যুগলে পরিণত হয় তারই তীক্ষ নির্ভরযোগ্য বর্ণনা। এ বইটিতে গ্রিনব্ল্যাট মিল্টনের মহত্ সৃষ্টি ‘প্যারাডাইস লস্ট’ আলোচনায় আনতে গিয়ে বলেন যে মিল্টনের নিজের জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে নানা পর্যায়ের মান-অভিমান, বিগ্রহ, গ্রহণ-বর্জন-গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে ছায়া ফেলেছে তাঁর আদম এবং হাওয়ার দাম্পত্যজীবন চরিত্রায়ণে। ঠিক সেভাবে কবি নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন থেকেও নজরুলের ইসলাম ধর্মকে বাংলাকরণের চিন্তার বীজ খুঁজে পাওয়া যায়। আমি বছর দুয়েক আগে নজরুলের চুরুলিয়া গ্রামে তাঁদের বসতবাটি দেখতে যাই। ভ্রমণার্থীর চোখ দিয়ে দেখে আমার মনে হয়েছে, গ্রামটি একান্তই মুসলমান অধ্যুষিত এবং সংস্কৃতিও ইসলামিক। মনে পড়ছে, নজরুলের বাড়ির সামনের রাস্তার উল্টো দিকের আরেক বাড়ির সীমানাদেয়ালের গাত্রে নজরুলের এমন একটি দীর্ঘ বাণী লেখা আছে, যেটা এর আগে আমি কোথাও পড়েছি বা দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না। বাণীটি এখন মনে পড়ছে না, তবে যতটুকু মনে করতে পারছি, এটি ছিল নজরুলের মক্কা-মদিনায় শারীরিকভাবে গিয়ে হজব্রত পালন করতে না-পারার অনুতাপসংবলিত। অথবা এমনো হতে পারে যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অনিশ্চিত সাম্প্রদায়িক আবহে নজরুলের উত্তরসূরিরা নজরুলের মুসলমানিত্ব সবিশেষ প্রকাশ করার জন্য এ উক্তিটি বেছে নিয়েছেন।
নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমেদ নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। ইসলামের সব পর্ব ও আচার তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন। তিনি ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁর উদার মনোভাব ছিল। তিনি মারা যান নজরুলের বয়স যখন ৯ বছর। কিন্তু পিতার কিছু বৈশিষ্ট্য নজরুলের মধ্যে থাকাই স্বাভাবিক। আবার নজরুলের এক চাচা কাজী বজলে করিম ছিলেন ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত। গ্রামের যে মক্তব থেকে নজরুল নিম্ন প্রাইমারি পাস করেন, সেখানকার একজন শিক্ষক ছিলেন কাজী বজলে আহমেদ। এঁরা দুজনই নজরুলকে আরবি-ফারসি ও উর্দু শিখতে সাহায্য করেন। দেখা যায়, অতি অল্প বয়সে লেটোদলের জন্য পালা রচনা করতে গিয়ে নজরুল একটি কবিতা লেখেন, যাতে প্রচুর বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ দেখা যায়।
কবি নজরুলের জীবনে তাঁর প্রাণের চেয়ে প্রিয়, দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের ১৯৩০ সালে মাত্র সাড়ে চার বছর বয়সে বসন্ত রোগে মৃত্যুর ঘটনা কবিকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে একান্ত দুর্বল করে ফেলে। অপরিসীম শোকে গান রচনা করেন, ‘ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।’ অধ্যাপক প্রীতি কুমার মিত্র তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল : পোয়েট্রি অ্যান্ড হিস্ট্রি’ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৭) জানালেন, মৃত্যুটি নজরুলের চেতনার জগতে গভীর রেখাপাত করে এবং তিনি বিদ্রোহীর ভূমিকা থেকে অধ্যাত্মবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এ পর্বে তাঁর সহায় হয় সংগীত (১৯৩০-৪২)। অবশ্য এর আগে থেকেই, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরে বাসকালীন (জানুয়ারি ১৯২৬-ডিসেম্বর ১৯২৯) এবং পুত্র বুলবুলের জন্ম থেকে (১৯২৬), নজরুল বাংলা গানে গজল আমদানি করে বাংলা সংগীতের নতুন দ্বার উদ্ঘাটন করেন।
ওপরের বিভিন্ন দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যায়, নজরুল তাঁর বহু-ভাষিকতার ক্ষমতাকে একটি তাত্ত্বিক পরিণতি দিতে অগ্রসর হচ্ছিলেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্কচ্ছলে ‘বড়র পীরিতি বালির বাঁধ’ শীর্ষক প্রবন্ধের এক জায়গায় লিখলেন, “বাঙলা কাব্য-লক্ষ্মীকে দুটো ইরানি ‘জেওর’ পরালে তার জাত যায় না, বরং তাঁকে আরও খুবসুরতই দেখায়।” সেটি হলো বাংলা ভাষাকে যদি মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশি শব্দ দিয়ে ঋদ্ধ করা যায়, তাহলে বিদেশি ভাষায় বাঙালি মুসলমানরা যে ধর্ম পালন করে, সেটা যদি ভাষান্তর করা যায় বাংলায়, তাহলে বাঙালি মুসলমান ধর্মের মূল আলোয় পৌঁছতে পারবে।
নজরুলের এ প্রচেষ্টাটি আমার কাছে খুব আশাব্যঞ্জক তত্ত্ব বলে মনে হয়।
Post a Comment