নিষিদ্ধ ৫২ খাদ্যপণ্য জীবনঘাতী উপাদানে পূর্ণ
বিএসটিআইর পরীক্ষায় নিুমান প্রমাণিত ৫২ পণ্যে জীবনঘাতী উপাদানের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পণ্য ব্যবহারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।
রোববার আদালতের নির্দেশের পর সোমবারও বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব পণ্য। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে প্রাণসহ নামিদামি কোম্পানি ও ব্র্যান্ডের পণ্য পাওয়া গেছে। এদিকে ৫২ পণ্যের বিক্রি নিষিদ্ধের জন্য ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশের পর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তৎপরতা বেড়েছে।
পণ্যের লাইসেন্স বাতিল এবং মামলাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই)। আদালতের আদেশের কপি হাতে পেলে ব্যবস্থা নেবে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
বিএসটিআইয়ের পরীক্ষায় নিুমান প্রমাণিত হওয়ায় প্রাণের গুঁড়া হলুদ, কারি পাউডার, লাচ্ছা সেমাইসহ বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্র্যান্ডের ৫২টি খাদ্যপণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে এসব খাদ্যপণ্য বিক্রি ও সরবরাহে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আগামী ১০ দিনের মধ্যে সংস্থা দুটিকে এসব নির্দেশ বাস্তবায়ন করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রোববার রুলসহ এ আদেশ দেন।
জানতে চাইলে বিএসটিআইর পরিচালক প্রকৌশলী এসএম ইসহাক আলী যুগান্তরকে বলেন, ৫২টি পণ্যের মধ্যে ২৪টি ঢাকায়। এগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৭টি পণ্যের ব্যাপারে জবাব পাওয়া গেছে।
বাকি ৭টির ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির জবাব পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, যেগুলো জবাব দেয়নি, প্রাথমিকভাবে এগুলোর লাইসেন্স বাতিলসহ পর্যায়ক্রমে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও এসব পণ্য না কেনার ব্যাপারে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হবে। আর যেগুলো জবাব দিয়েছে, তাদের জবাব সন্তোষজনক না হলে, আপাতত এদের লাইসেন্স স্থগিত হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএসটিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সম্পূর্ণ ছাই আর রং মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রাণের গুঁড়া হলুদ ও কারি পাউডার। এরপর চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে বাজারজাত করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির লাচ্ছা সেমাইয়ে রয়েছে উচ্চমাত্রায় চর্বি।
এছাড়া রয়েছে সিসা, আর্সেনিকের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর উপাদান। এগুলো ব্যবহারে মানুষের ক্যান্সার হতে পারে। এ ব্যাপারে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, গত বছর দেশে ক্যান্সারের আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।
এর অন্যতম কারণ হল খাদ্যে বিষ। এছাড়া মিঠাইয়ের লাচ্ছা সেমাইতে পুরাটাই ক্ষতিকারক চর্বি। সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের সরিষার তেলে রয়েছে ক্ষতিকারক আয়রন। এছাড়া গ্রিন ব্লিচিংয়ের জিনি সরিষার তেলে আয়রন ও উচ্চমাত্রায় এসিড পাওয়া গেছে। একই অবস্থা শমনমের পুষ্টি সরিষার তেল এবং বাংলাদেশ এডিবল অয়েলের রূপচাঁদা সরিষার তেলে। কাশেম ফুডের সান চিপসে পাওয়া গেছে শুষ্ক চর্বি।
এদিকে সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শান্তিনগর কাঁচাবাজার, নয়াবাজার ও কেরানীগঞ্জের সর্ববৃহৎ জিঞ্জিরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরও এসব পণ্য দেদার বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোও তাদের পণ্য বাজার থেকে প্রত্যাহারের কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়নি। নয়াবাজারের একাধিক মুদি বিক্রেতা জানান, যেসব পণ্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেগুলো পত্রিকা ও টেলিভিশনে দেখেছি। কিন্তু সব মানুষ এগুলো দেখেনি।
তারা বলেন, নামিদামি কোম্পানির পণ্যের চাহিদা সব সময় থাকে। এ কারণে মানুষ এগুলো কিনছে। কোম্পানির পক্ষ থেকে এসব পণ্য বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা বা পণ্য পরিবর্তন করতে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।
বিএসটিআইর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যের গুণগত মান নেই আররা ফুডের আরা ড্রিংকিং ওয়াটার, আল সাফির ড্রিংকিং ওয়াটার, মিজানের ড্রিংকিং ওয়াটার, মর্ন ডিউয়ের ড্রিংকিং ওয়াটার, ডানকানের ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটার, আরার ডিউ ড্রিংকিং ওয়াটার, দীঘির ড্রিংকিং ওয়াটারে। এছাড়া ডুডলি নুডলসে অতিরিক্ত চর্বি, শান্ত ফুডের সফট ড্রিংকস, জাহাঙ্গীর ফুড সফট ড্রিংকে এসিডের পরিমাণ বেশি। ড্যানিশের হলুদের গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে।
তানভির ফুডের ফ্রেশ হলুদের গুঁড়ায় মাত্রাতিরিক্ত সিসা পাওয়া গেছে, এসিআইয়ের ধনিয়ার গুঁড়ায় পুরোটাই ছাই, ড্যানিশ কারি পাউডারে সিসা ও আর্সেনিক, বনলতার ঘিতে তরল পদার্থ ও ক্ষতিকারক এসিড এবং পিওর হাটহাজারী মরিচ গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে। এছাড়াও মিষ্টিমেলা, ওয়েল ফুড ও মুধবনের লাচ্ছা সেমাইতে অতিরিক্ত চর্বি, এসিআইয়ের আয়োডিনযুক্ত লবণ, কিংয়ের ময়দা, রূপসার দই, মক্কার চানাচুরে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি পাওয়া গেছে।
মেহেদির বিস্কুট, বাঘাবাড়ীর স্পেশাল ঘিতে কোনো উপাদানই ঠিকমতো নেই। নিশিতা ফুডসের সুজিতে ক্ষতিকারক কণা পাওয়া গেছে। মঞ্জিলের হলুদ গুঁড়া, সান ফুডের হলুদ গুঁড়া, ডলফিনের মরিচ গুঁড়া, ডলফিনের হলুদ গুঁড়া, সূর্যের মরিচের গুঁড়ায় ছাই পাওয়া গেছে। কিরণের লাচ্ছা সেমাই, জেদ্দার লাচ্ছা সেমাই এবং অমৃতের লাচ্ছা সেমাইতে পাওয়া গেছে মাত্রাতিরিক্ত চর্বি।
দাদা সুপার, তিন তীর, মদিনা স্টারশিপ, তাজ, নুর ও মধুমতির আয়োডিনযুক্ত লবণ, মোল্লা সল্টের আয়োডিন লবণে ক্ষতিকারক সোডিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গেছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম শামসুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, খাবারে অধিক ময়েশ্চার আর্দ্রতার কারণে এক ধরনের ফাঙ্গাস সৃষ্টি হয়। ‘এসপারজাইলাস ফ্লেভাস’ নামক এ ফাঙ্গাস খাবারে আফলাটক্সিন নামক বিষাক্ত পদার্থ নিঃসরণ করে। এসব খাবার খেলে মানুষের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
এছাড়া আর্দ্রতার এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ ঘটে। এসব ব্যাকটেরিয়া খাবারে ‘বেসিলাস সিরিয়াস’ তৈরি করে। যা মূলত এক ধরনের সাইটোটক্সিন। এ ধরনের সাইটোটক্সিন খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে মারাত্মক আমাশয় ঘটায়। তিনি বলেন, খাবারে বা লবণে ময়েশ্চার বেশি থাকলে সেই খাবার ভেজা থাকবে। ফলে খাবারের গুণগতমান দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। খাবার তার খাদ্য উপযোগিতা হারাবে।
অধ্যাপক শামসুজ্জামান বলেন, যে কোনো খাদ্য উপাদানে আর্সেনিক থাকা বিপজ্জনক। দীর্ঘদিন মানুষ যদি আর্সেনিক সমৃদ্ধ খাবার খায় তাহলে আর্সোনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হবে। যার ফলে মানুষ ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হবে। লেড বা সিসা একটি ভারি ধাতু। যে কোনো ভারি ধাতুই মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
Post a Comment